রাত ১টা, কাজিপাড়া গ্রামের কবরস্থান। নিগূঢ় আধার গিলে খেয়েছে রূপালি চাঁদ, কুয়াশার ঘন পর্দায় আরো গাঢ় হয়েছে তমসালীলা। কৃষ্ণপক্ষের ভয়ংকর তমসালীলা। শুকনো পাতার মরমর শব্দ, নিজের কৃষ্ণ ছায়াও যেন হাত বাড়িয়ে পা টেনে ধরে। কুকুর শেয়ালের হুংকার, আগেই জানান দিচ্ছে তাদের এলাকায় ঢোকা বারণ। বাঁশবনের নুয়ে আসা গা ছমছমে বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে শান্ত কবরস্থান, যেখানে জীবন্ত মানুষের দেখা মেলে না। লোমহর্ষক নীরবতা এবং কবরের সারির নিস্তব্ধতা। মৃতরা নাকি কথা বলে না, শুধু তাদের আহাজারি থাকে জীবন্ত। নীরবে, চুপিসারে ফিসফিসিয়ে কানে কানে বলে, “একদিন এখানেই আসতে হবে, নিঃসঙ্গ, একা।” যে কবরস্থানে মানুষের যেতেও আত্মা কাঁপে, দিনের বেলাও গায়ে কাঁটা দেয়। সেখানে কৃষ্ণপক্ষের মধ্যরাতে কোদাল কাঁধে ব্যস্ত পায়ে সেদিকেই ছুটছে শ্রাবণ। তার ব্যস্ত পায়ে পিষছে শুকনো পাতা। শিরশিরে শব্দ দূর থেকে পাওয়া যাচ্ছে। হাতে লম্বা গজ ফিতা। মস্তিষ্কে কি চলছে জানা নেই। কবরস্থান বাড়ি থেকে শ’খানেক মিটার দূরে। মহব্বত আলী রাতে প্রস্রাব করতে বাহিরে এসে খানিকটা চমকালেন, ভড়কালেন সামান্য। এমন কিছুর সম্মুখীন হবেন কল্পনাও করেননি। ঘন কুয়াশার পর্দায় স্পষ্ট দেখা না গেলেও অবয়বে ভালোভাবেই বুঝা যাচ্ছে কবরস্থানের দিকে যাওয়ার লোকটি অন্য কেউ নয় বরং শ্রাবণ। প্রতিবেশী বলে তার অবয়ব চেনাটা অসম্ভব কার্য নয়। তার কপালে ভাজ পড়লো, মনে প্রশ্নের লহর উঠলো। অন্য কেউ হলে এতক্ষণে ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠতো নয়তো মানুষ জড়ো করে বিশ্রী একটি পরিবেশ তৈরি করতো। অস্বাভাবিক নয়, মধ্যরাতের আলো আঁধারে একটি তাগড় যুবককে কবরস্থানের দিকে হন্নে হয়ে ছুটতে দেখা নিশ্চয়ই কেউ প্রত্যাশা করে না। অথচ মহব্বত আলী তেমন কিছু করলেন না, কাউকে না ডেকে চুপিসারে শ্রাবণের পিছু নিলেন। দূরত্ব রেখে পুরোনো তেঁতুল গাছের আড়াল থেকে ঘাপটি মেরে সব দেখতে লাগলেন। শ্রাবণ একটি গাছের সাথে দাঁড়িয়ে নিজের উচ্চতানুসারে গাছে একটা দাগ দিল। তারপর ফিতা দিয়ে মেপে নিল দাগ পর্যন্ত। কোদালের সাহায্যে নির্দিষ্ট একটা জায়গার শুকনো পাতা, আগাছা পরিষ্কার করে মাপ মত খুঁড়তে শুরু করলো। এসব দেখে মহব্বত আলীর আর বুঝতে বাকি থাকলো না যে, শ্রাবণ নিজেই নিজের জন্য কবর খুঁড়ছে।