'এতরাতে আপনি! কিছু বলবেন?' কাঁধ নাচিয়ে হাসল ইয়ামিন। বলল, 'আপনার নাটকটা দেখতে এলাম। সুযোগ পাব?' 'কীসের নাটক?' 'এইযে, ভদ্রলোক আপনার বাবা নন, কিন্তু বাবা ডাকছেন।' মৌসন্ধ্যা দাঁত কামড়ে হাসি আড়াল করে বলল, 'মাথা ঠিক আছে আপনার?' 'আমাকে কি পাগল মনে হয়?' 'কী জানি! বুঝতে পারছি না। হতেও তো পারেন। চারিদিকে এত এত খুন দেখে হয়তো মাথা আর জায়গায় নেই। অনেক আগেই সব তাঁর ছিঁড়ে গিয়ে...' কথা শেষ করতে পারল না মৌসন্ধ্যা। চোখ গরম করে তাকাল ইয়ামিন। ধমকে উঠে বলল, 'আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন, আমি আইনের লোক। মশকরা করার মতো কোনো সম্পর্ক আমাদের নেই। অযথা লুকোচুরি না করে সত্যিটা বলুন। কেন এই মিথ্যে নাটক করলেন?' জোরপূর্বক ঘরের ভেতর প্রবেশ করল ইয়ামিন। ইকরাম হাসান সহ্য করতে পারলেন না। বললেন, 'এসব কী হচ্ছে অফিসার?' 'কিছুই না আংকেল। এতদিন যে নাটকটা চালিয়ে গিয়েছেন, সেটা এবার বন্ধ করতে এলাম।' ভদ্রলোক জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলেন। শরীরে শক্তি নেই বিধায়, উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে পারলেন না। শুধু মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'এসব কী শুনছি সন্ধ্যা? আমি তোকে কতবার বলেছি, এসব বিষয়ে মাথা ঘামাস্ না। তোর জন্য আজ এই কথা শুনতে হচ্ছে। আমি তোর বাবা নই, এটা শুনার আগে আমার মরণ হয়ে যেত, তা-ও ভালো ছিল।' মৌসন্ধ্যা চরম অসহায় চেহারায় বাবার দিকে তাকাল। ঘাবড়ে গেল তৎক্ষণাৎ। ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বলল, 'আব্বু, কী হয়েছে তোমার?' ইয়ামিন যথেষ্ট বিরক্ত হলো এসব নাটকে। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল তার। দু'পা এগিয়ে এসে দাঁড়াল বাবা-মেয়ের সামনে। রুক্ষ্ণস্বরে বলল, 'আপনারা এই নাটক বন্ধ করুন প্লিজ। নেয়া যাচ্ছে না এসব।' মৌসন্ধ্যার কানে গেল না সে কথা। সে ইকরাম হাসানের শরীরের দুর্বলতা ও ক্রমশ নেতিয়ে যাওয়া দেখে ঘাবড়ে গেছে। তিনি যে শ্বাস টানতে পারছেন না সেটা বুঝতে পেরে দ্রুত ফাস্ট-এইড বক্স থেকে ইনহেলার বের করে বার দু'য়েক ঝাঁকুনি দিয়ে ইকরাম হাসানের মুখের সামনে ধরে রাখল। তাতেও কাজ হলো না। উলটে বুকের ওঠানামা বৃদ্ধি পেল। উপায়ন্তর না পেয়ে ঘরের বাইরে আসলো মৌসন্ধ্যা। গাড়ি কোথায় পাবে? তার বাবাকে হাসপাতালে নেয়া দরকার। কোথাও কোনো গাড়ি নেই। সাহায্য করার মতো কেউ নেই। সে প্রচণ্ড দিশেহারা হয়ে দু'হাতে বয়স্ক মানুষটাকে তুলে ধরে বলল, 'কিচ্ছু হবে না আব্বু। আমরা এক্ষুণি হাসপাতালে যাব।' রাগে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে ইয়ামিন। একটা মানুষ আর কত মিথ্যে অভিনয় করবে, ভেবে পেল না সে। মেজাজ হারিয়ে ফেলে হাত দিয়ে ধাক্কা মারল মৌসন্ধ্যাকে। বলল, 'বলছি না, নাটক বন্ধ করুন! বাবা-মেয়ে মিলে এসব কী শুরু করেছেন?' আচমকা ধাক্কায় খানিকটা টালমাটাল পরিস্থিতিতে পড়ে গেল মৌসন্ধ্যা। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ইয়ামিনকে বলল, 'বড্ড বাড়াবাড়ি করছেন আপনি। আমাকে হাসপাতালে অবধি যেতে দিন। আব্বুর অনেক কষ্ট হচ্ছে। তাকে বাঁচাতে হবে। প্লিজ...।' 'স্যরি। আমি এসব নাটক আর দেখতে চাইছি না। অসহ্য লাগছে। যিনি আপনার বাবা নন, তাকে বাবা বলে আদিখ্যেতা করা বন্ধ করুন।' দুটো হাত একত্রে করে ইয়ামিনের পায়ের কাছে বসে পড়ল মৌসন্ধ্যা। চোখের পানি আটকে বলল, 'হাত জোর করে বলছি, আমাকে হাসপাতালে যেতে দিন। আব্বুর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কেন বুঝতে পারছেন না, আপনি? উনি খুব অসুস্থ।' 'এটাও একটা নাটক। উনি সম্পূর্ণ সুস্থ।' 'আর কীভাবে বললে বিশ্বাস করবেন আপনি? উনি-ই আমার বাবা। আমি কোনো নাটক করছি না।' 'আপনি বার বার আমাকে বোকা বানাবেন, আমিও বোকা হয়ে আপনার কথাতে বিশ্বাস করব? স্যরি মৌসন্ধ্যা। এই মিথ্যেটাকে অন্তত আজ আর সত্যি হিসেবে গ্রহণ করছি না। আপনারা বাবা-মেয়ে দু'জনেই মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছেন। সাহায্যের নামে আইনের চোখে ধুলো দিয়েছেন। আশেপাশের সব মানুষকে বোকা বানিয়েছেন। শাস্তি তো আপনাকে পেতে হবে।'