কিন্তু নানা রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে, ব্যক্তি, বর্ণ ও শ্রেণীস্বার্থবুদ্ধির প্রেরণায় সমাজদেহ যখন ভিতর থেকে ক্রমশ পঙ্গুত্ত দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন ভিতরে ভিতরে জড়ের জঞ্জাল এবং মৃতের আবর্জনা ধীরে ধীরে জমিতে জমিতে পুঞ্জ পুঞ্জ স্তূপে পরিণত হয়। জীবনপ্রবাহ তখন আর স্বচ্ছ সবল থাকে না, মরুবালিরাশির মধ্যে তা রুদ্ধ হয়ে যায়, অথবা পঙ্কে পরিণত হয়। সমাজদেহে তখন ভিতর-বাহিরের কোনো আঘাতই সহ্য করার মতো শক্তি ও বীর্য থাকে না, প্রত্যাঘাত তো দূরের কথা। বিবর্তনের যুক্তিও তখন আর সক্রিয় থাকে না। বস্তুত, দান ও গ্রহণের সমন্বয় ও সাঙ্গীকরণের যে যুক্তি বিবর্তনের গোড়ায়, অর্থাৎ বিবর্তনের যা স্বাভাবিক জৈব-নিয়ম, তা পালন করার মতো শক্তিই তখন আর সমাজদেহে থাকে না। সমাজের এই অবস্থাই বিপ্লবের ক্ষেত্র রচনা করে। বস্তুত, এটি বিপ্লবের ইঙ্গিত। কিন্তু ইঙ্গিত থাকলেই, ক্ষেত্র প্রস্তুত হলেই বিপ্লব ঘটে না। সেই ইঙ্গিত দেখার ও বুঝার মতো বুদ্ধি ও বোধ থাকা প্রয়োজন, ক্ষেত্রে ফসল ফলানোর মতো প্রতিভা ও কর্মশক্তি, সংহতি ও সংঘশক্তি থাকা প্রয়োজন। নইলে ইঙ্গিত ইঙ্গিতই থেকে যায়, সময় বহিয়ে যায়, বিপ্লব ঘটে না। এমন অবস্থায় বাহির থেকে ঝড় আসলে যখন বুকের উপর ভেঙে পড়ে, তখন আর তা ঠেকানো যায় না; এক মুহূর্তে সমস্ত ধূলিসাৎ হয়ে যায়। বিপ্লবের ইঙ্গিত অন্যতর, নূতনতর ইঙ্গিতে বিবর্তিত হয়ে যায়, ক্ষেত্রের চেহারাই অনেক সময় একবারে বদলে যায়, একেবারে নূতন সমস্যা দেখা দেয়। আর বাহির থেকে ঝড় না লাগলে, যথাসময়ে বিপ্লব না ঘটালে পঙ্গু, দুর্বল ও ক্ষীয়মাণ সমাজ আপনা থেকেই তখন ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং একদিন জৈব-নিয়মেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।