বাংলার কৃষক সমাজ ইংরেজ এবং জমিদার ও তাদের নিয়োগকৃত কর্মচারীদের অত্যাচার সব সময় নীরবে সহ্য করেনি। কখনো তারা অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। কোম্পানির শাসনামলে কৃষকরা রাজস্ব কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। ১৭৮৩ সালে দিনাজপুর ও রংপুরের কৃষকরা সম্মিলিতভাবে জমিদারের ম্যানেজার দেবী সিংহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। বাঙালি কৃষকরা শান্ত প্রকৃতির হলেও তারা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন ছিল। তাদের উপর অত্যাচারের প্রতিকারে মাঝে-মধ্যে তারা বিদ্রোহ করেছে। মুসলিম শাসনামলে নীল চাষ ছিল বাংলার কৃষকদের ইচ্ছাধীন। বাংলাদেশ ছাড়া বিহারেও নীলের চাষ করা হতো। সপ্তদশ শতকে বাংলাদেশের উৎপাদিত নীল ইউরোপে রপ্তানি শুরু করে ইউরোপীয় বণিকগণ। আমেরিকার ব্রিটিশ উপনিবেশগুলো স্বাধীনতা লাভ করার পর সেখানে ব্রিটিশদের নীলের ব্যবসায় বন্ধ হয়ে যায়। যার ফলে বাংলাদেশ তখন নীল সরবরাহের প্রধান কেন্দ্র হয়ে পড়ে। কোম্পানির শাসনামলে ব্রিটিশ বণিকরা বাংলায় একচেটিয়া নীলের ব্যবসায় দখল করে নেয়। তারা বিভিন্ন স্থানে নীলকুঠি স্থাপন করে। প্রথম দিকে নীলের চাষ চাষীদের জন্য খুবই লাভজনক হলেও পরবর্তীতে প্রজাদের উপর জোর-জবরদস্তি করে নীলকররা নীলের চাষ করাতো। তাতে কৃষকরা যে মূল্য পেতো তা ছিল নিতান্তই কম। যার ফলে নীলের চাষ করে কৃষকদের বিঘাপ্রতি সাত টাকা ক্ষতি হতো। ১৭৯৫ সালের নির্ধারিত নীলের মূল্য অনুযায়ীই কৃষকরা নীল চাষ করতো এবং তাতে করে তাদের উচ্চহার সুদে ঋণ বা দাদন নিতে হতো। এই দাদনের মূল্য পরিশোধ করতে গিয়ে কৃষকদের আর্থিক অবস্থা চরম খারাপ হয়ে যেতো। এমতাবস্থায় সৈয়দ নিসার আলী ওরফে তিতুমীর ১৮২৭ সালে সৈয়দ আহমদ শহীদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে বাংলায় ধর্মীয়, সমাজ-সংস্কার এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা করেন। এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপলাভ করে। তিতুমীরের দ্বারা পরিচালিত ১৮৩১ সালের বিদ্রোহ বাংলার কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ করে। ব্রিটিশেেদর বিরুদ্ধে তিতুমীরের বিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়ে লিখিত ইতিহাসে ভিন্ন ভিন্ন মত লক্ষণীয়। এ পুস্তকে তিতুমীর : জীবন ও কমর্র্ শিরোনামে পাঁচটি অধ্যায়ে ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের প্রেক্ষাপটে তিতুমীরের সংগ্রামী জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে তিতুমীরের জন্ম ও প্রাথমিক জীবন, দ্বিতীয় অধ্যায়ে তিতুমীরের মক্কা জীবন, তৃতীয় অধ্যায়ে তিতুমীরের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ, চতুর্থ অধ্যায়ে তিতুমীরের মতাদর্শ, পঞ্চম অধ্যায়ে তিতুমীরের বিদ্রোহ এবং পরিশেষে উপসংহার তুলে ধরা হয়েছে।