লাবণ্য গা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালো। হঠাৎ পৃথিবীটা তার কাছে খুব নিষ্ঠুর ঠেকছে। মা মরে যাবার এত তাড়াহুড়ো কি ছিল? শাহানা তার অবহেলা করেনি। তবু, নিজের মা হলে তার গায়ের রঙ নিয়ে হয়ত এত দুশ্চিন্তা করত না। লাবণ্যকে সময় দিতো। তার পছন্দ-অপছন্দ জানতে চাইতো। বাবা-মায়ের মুখের ওপর কথা বলতে পারত। মা মরা এতিম মেয়েকে মায়ের আদরে বড় করার জন্য সারাজীবন কৃতজ্ঞ ও কৃতার্থ হয়ে থাকত না। নাটকপাড়া থেকে বেরিয়ে লাবণ্য বেইলি রোডের ফুলের দোকানের কাছে এসে থামলো। শাহানা তাকে বলেছেন, রাজু ভাস্কর্যের সামনে সেই লোকটি থাকবে। তাকে কেমন করে চিনবে জানতে চাইলে শাহানা বলেছেন, তার হাতে থাকবে নীল রুমাল। লাবণ্য বলতে চেয়ে ছিল, যদি তিনটা লোকের হাতে নীল রুমাল থাকে তাহলে সে কি করবে? তিনজনকে গিয়ে একে একে প্রশ্ন করবে, 'এই যে, আপনি কি আমাকে বিয়ে করতে এসেছেন?' রাস্তায় রিকশা কম। লাবণ্য দশ টাকার বাদাম কিনে হাঁটতে শুরু করলো। আকাশে প্রচুর মেঘ। মাঝেসাঝে মেঘের আড়ালে সূর্য লুকিয়ে পড়ছে। তখন আরাম করে অনেকখানি হাঁটা হয়ে যায়। লাবণ্য আজও শাড়ি পরেছে। কপালের ওপরের চুলগুলো বিরক্ত করছে দেখে সে ঠেলে চুল ওপরে উঠালো। এবং উঠিয়ে বুঝলো, কি ভুল হয়েছে। লবণ-মরিচ মাখানো হাত চোখে কপালে লেগে যাচ্ছে, তাই অবস্থা। লাবণ্য আতিপাতি করে ব্যাগ খুঁজল। পানির বোতল নেই। থিয়েটারে বসেছিলো যখন, হয়ত গড়িয়ে গেছে মেঝেতে। লাবণ্য চোখ বন্ধ করে সামনে দু' হাত তুলে অন্ধ মানুষের মতো হাতড়ে বেরাচ্ছে। পথচারীদের কৌতূহল জাগা পর্যন্ত। কেউ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো না। একটি রূপসী নারী হলে তার স্থানে ভীড় জমে যেত। লাবণ্যের পোড়া কপাল সে কালো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে শুরু করেছে লাবণ্য। পৃথিবীর নিঠুর নিয়মের ভীড়ে কষ্ট কমাতে হয়ত বৃষ্টি নামালো বিধাতা। তার ঝড়ো হাওয়ায় ধুয়ে গেলো লাবণ্যের চোখ। দৃষ্টি মেলে লাবণ্য দেখতে পেলো, একটি অপূর্ব সুন্দর ছেলে এক বোতল পানি এবং সাদা রুমাল তার দিকে এগিয়ে ধরে বৃষ্টিতে ভিজে চলেছে। ছেলেটির চশমার কাঁচ গড়িয়ে পড়া পানি ধরে দেখতে ইচ্ছে হলো লাবণ্যের। ছেলেটি কথা বললো। 'গাড়ি থেকে দেখলাম আপনাকে। জ্যামে বসে পুরোটা দেখেছি। বাদামের ঝাল লেগে একসা অবস্থা। পানি নিয়ে আসতে বৃষ্টি নামলো। আপনি কি পাগল বলুন তো। মাঝ রাস্তায় কেউ এভাবে দাঁড়িয়ে যায়?' লাবণ্য জবাব দিলো না। এই ছেলেটির তাকে দয়া দেখাবার কোন কারণ নেই। অপূর্ব সুন্দর পুরুষ মানুষেরা দয়া দেখাবে এবং প্রেমে পড়বে অপূর্ব সুন্দরী রমনীদের। লাবণ্য ভিজে ভিজে হাঁটছে। তার হালকা গোলাপী সুতি শাড়ি, কপালে আঁকা কুমকুম টিপ, হাতের রেশমী চুড়ি ছাপিয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনের বেদনার ছাপ প্রকট। যুবক এগিয়ে এলো। 'আপনি খুব কষ্টের ভেতর রয়েছেন, মিস লাবণ্য। আমরা কি কোথাও বসতে পারি?' লাবণ্যের পথ থমকে গেলো। যুবক তার নাম জানলো কেমন করে। ভুল করে নিজের নাম বলে ফেলেনি সে। লাবণ্যের মন বুঝে হেসে দিলো যুবক। 'আমি অরণ্য। আমার আম্মা আপনার সৎ মা শাহানা আন্টির বান্ধবী।' লাবণ্যের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি থাকছে না। অরণ্য এবার বৃষ্টি ঢাকতে মাথায় হাত তুলে ছাদ ধরলো। লাবণ্য হেসে ফেললো। ছেলেবেলায় স্কুলে খেলার সময় দুই হাত মাথার ওপর তুলে এভাবে ফুল কলি সাজতো ওরা। অরণ্যকে তেমন লাগছে। 'বেশ, এখন দেখলেন তো। কোথায় আপনি এবং কোথায় আমি। ঝঞ্ঝাট কমে গেলো। বাড়ি গিয়ে সোজা 'না' জানিয়ে দিন। আপনার জীবন সুখময় হোক।' অরণ্য কিছু বুঝতে পারছে না। লাবণ্য তাকে তাড়িয়ে দিতে চায়। বৃষ্টি জোর বাড়ছে। লাবণ্য বাস শেডে দাঁড়িয়ে সেলিম সাহেবকে ফোন করে। গাড়ি থাকলে আজকে তাকে ভিজতে হতো না। রব ভাইকে জেল থেকে ছাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ এই বোঝানো তার আসল উদ্দেশ্য। সেলিম সাহেব মেয়ের ফোন ধরলেন না। লাবণ্য এবার হাল ছেড়ে দিলো। বাস জ্যামে পড়েছে নির্ঘাত। এবার বাড়ি যেতে খবর হবে। অরণ্য লিপ রিডিং জানে। লাবণ্যের বিড়বিড় করে বলা কথা ধরে ফেলেছে। 'কয়টার সংবাদে আপনাকে আবার দেখতে পাবো তাহলে।' 'আপনি যাননি। যত দ্রুত যাবেন এবং বাসায় জানাবেন, আমার মা তত দ্রুত অন্য পাত্র দেখবে।' 'আমাকে তাহলে রিজেক্ট করে দিলেন, মিস লাবণ্য বেগম।' লাবণ্য চোখ বিশাল করে তাকালো। তার নামের শেষে অবলীলায় বেগম ডাকছে অরণ্য। এই ছেলে হাফ পিএইচডি! মনে হয় তথ্যে ভুল রয়েছে। পিএইচডি করা ছেলেরা হয় গম্ভীর। এই ছেলে কথায় কথায় হাসছে এবং লাবণ্যকে হাসাবার চেষ্টা করছে। লাবণ্য নিশ্চিত হলো, এটা ফ্রড। কোনভাবে তার নাম জানতে পেরে তাকে কিডন্যাপ করতে এসেছে। যাত্রীছাউনিতে বিক্ষিপ্তভাবে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টির জন্যে যে যার গা বাঁচাতে ব্যস্ত। লাবণ্য সরে যায়। এটা সেই অজ্ঞান পার্টির সদস্য হতে পারে। প্রথমে গাড়ি এবং পরে লাবণ্যকে টার্গেট করেছে। 'আমি চোর ডাকাত নই। আপনি চাইলে আমার পাসপোর্ট দেখতে পারেন।' 'লাগবে না। আপনি যদি এখনি না যান, আমি লোকজন ডেকে বিচার দেব।' 'সে আপনি দিতে পারেন। মানসিকভাবে আপনাকে শক্ত লাগছে। তবে অল্পতে বেশি ভয় পান। যা এর উল্টো। অর্থাৎ, বিপদ এলে আপনি পালিয়ে যান। মোকাবেলা করতে পারেন না।' 'আমাকে আমার মত থাকতে দিন। আপনি রাস্তা মাপুন।' 'ঠিক আছে। তবে, যদি বাস না পান। রাস্তার উল্টো দিকে ঐ পাকুড় গাছের নিচে আমার গাড়ি আছে। দরজায় লক ওপেন করে রাখবো। আপনি এসে নির্দ্বিধায় উঠে যাবেন।' 'ঠিকাছে, এবার যান।' অরণ্য লাবণ্যকে পিছে ফেলে হাঁটলো। তার মন বলছে, লাবণ্য আসবে এবং একটি চমৎকার বিকেল তার কপালে বিধাতা লিখে রেখেছেন।